মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি নীতিমালা ২০২৫-২৬: জিপিএ কমল, নম্বর কাটাতে স্বস্তি, মানবন্টনে নতুনত্ব

মেডিকেল ভর্তি নীতিমালা ২০২৫-২৬: জিপিএ ৮.৫০, কমেছে সেকেন্ড টাইমে নম্বর কাটা!

0 25

মেডিকেল ভর্তি নীতিমালা ২০২৫-২৬: বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মেধাবী শিক্ষার্থীর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে ঘিরে প্রতি বছর যে ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তার মূল চাবিকাঠি হলো ভর্তি নীতিমালা। প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) সেই নীতিমালা প্রকাশ করেছে। তবে ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের এই নীতিমালায় এমন কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে, যা অনেক শিক্ষার্থীর ভাগ্য নতুন করে লিখতে পারে।

মেডিকেল ভর্তি নীতিমালা ২০২৫-২৬

একজন শিক্ষা প্রতিবেদক হিসেবে বহু বছর ধরে এই ভর্তি প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখছি। শিক্ষার্থীদের আশা-নিরাশা, প্রস্তুতি আর সামান্য নম্বরের ব্যবধানে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা—সবই পরিচিত দৃশ্য। আনন্দের বিষয় হলো, এবারের নীতিমালাকে (MBBS and BDS Admission Policy 2025-26) অনেকটাই শিক্ষার্থী-বান্ধব মনে হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় খবর? আবেদনের ন্যূনতম জিপিএ কমানো হয়েছে এবং বহুল আলোচিত ‘সেকেন্ড টাইমার’দের নম্বর কাটার পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। চলুন, এই নীতিমালার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বিস্তারিতভাবে জেনে নিই।

স্বস্তির খবর: মেডিকেল ভর্তিতে মোট জিপিএ যোগ্যতা কমল

গত কয়েক বছর ধরে মেডিকেল ভর্তির আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল এসএসসি এবং এইচএসসি মিলিয়ে মোট জিপিএ ৯.০০। অনেক শিক্ষার্থীর ভালো প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও এই কঠিন শর্তের কারণে তারা আবেদনের সুযোগই পেতেন না।

এবারের নীতিমালায় সেই শর্ত শিথিল করা হয়েছে।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেডিকেল বা ডেন্টালে ভর্তির আবেদনের জন্য এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় মোট জিপিএ কমপক্ষে ৮.৫০ থাকতে হবে।

তবে একটি শর্ত অপরিবর্তিত

যদিও মোট জিপিএ কমানো হয়েছে, তবে একটি জায়গায় বিএমডিসি কোনো ছাড় দেয়নি। তা হলো জীববিজ্ঞানের (Biology) গুরুত্ব।

  • অপরিবর্তিত শর্ত: আবেদনকারীকে অবশ্যই এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় জীববিজ্ঞানে ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫০ পেতে হবে। এটি ডাক্তার হওয়ার মৌলিক যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • উপজাতি ও অ-উপজাতি: পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী (সকল উপজাতি ও পার্বত্য জেলার অ-উপজাতীয়) প্রার্থীদের জন্য মোট জিপিএ ন্যূনতম ৮.০০ হতে হবে। তবে এক্ষেত্রেও জীববিজ্ঞানে ৩.৫০ জিপিএ বাধ্যতামূলক এবং এককভাবে কোনো পরীক্ষায় ৩.৫০ এর কম থাকা যাবে না।

সেকেন্ড টাইমারদের জন্য বড় সুযোগ: নম্বর কাটার নিয়মে ঐতিহাসিক পরিবর্তন

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সবচেয়ে বিতর্কিত এবং শিক্ষার্থীদের জন্য হতাশাজনক নিয়মগুলোর একটি ছিল ‘সেকেন্ড টাইম’ বা দ্বিতীয়বার অংশগ্রহণকারীদের নম্বর কাটা। গত শিক্ষাবর্ষেও (২০২৪-২৫) পূর্ববর্তী বছরের এইচএসসি পাস প্রার্থীদের মোট প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৬ নম্বর কেটে মেধাতালিকা তৈরি করা হতো।

এবারের নীতিমালায় সেই নিয়মে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।

নম্বর কাটার নতুন বনাম পুরাতন নিয়ম (তুলনা)

এই পরিবর্তনটি সেকেন্ড টাইমারদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় সুযোগ তৈরি করবে। নিচের টেবিলে দেখুন পার্থক্যটি:

ক্ষেত্র পুরাতন নিয়ম (২০২৪-২৫ পর্যন্ত) নতুন নিয়ম (২০২৫-২৬ থেকে)
পূর্ববর্তী বছরের এইচএসসি পাস (সেকেন্ড টাইমার) মোট নম্বর থেকে ৬ নম্বর কাটা হতো মোট নম্বর থেকে ৩ নম্বর কাটা হবে
পূর্ববর্তী বছর সরকারি মেডিকেলে/ডেন্টালে ভর্তি [পূর্বের সুনির্দিষ্ট তথ্য নীতিমালায় উল্লেখ নেই] মোট নম্বর থেকে ৫ নম্বর কাটা হবে

এর মানে কী? এর মানে হলো, যারা একবার ভর্তি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাননি, তারা এখন অনেক কম ‘পেনাল্টি’ বা লোকসান দিয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতে পারবেন। মাত্র ৩ নম্বর কাটা যাওয়ায় মূল পরীক্ষার পারফরম্যান্স দিয়ে এই ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া এখন অনেক সহজ হবে।

পরীক্ষার মানবন্টন ২০২৫-২৬: পদার্থবিজ্ঞানে কমল, গুরুত্ব বাড়ল সাধারণ জ্ঞানে

ভর্তি পরীক্ষার মূল ১০০ নম্বরের মানবন্টনেও একটি কৌশলগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ নম্বর কাটার নিয়ম বহাল থাকলেও, বিষয়ভিত্তিক নম্বরে সমন্বয় করা হয়েছে।

  • পদার্থবিজ্ঞান (Physics): নম্বর কমানো হয়েছে। আগে এটি ২০ থাকলেও এখন করা হয়েছে ১৫
  • সাধারণ জ্ঞান (General Knowledge): নম্বর বাড়ানো হয়েছে। আগে এটি ১০ থাকলেও এখন করা হয়েছে ১৫

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিবর্তনের ফলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জ্ঞানের গুরুত্ব মেডিকেলের মতো বিশেষায়িত ক্ষেত্রেও বৃদ্ধি পেল।

নতুন মানবন্টন (মোট ১০০ নম্বর)

  • পদার্থবিজ্ঞান: ১৫
  • রসায়নবিদ্যা: ২৫
  • জীববিজ্ঞান: ৩০
  • ইংরেজি: ১৫
  • সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ): ১৫

পরীক্ষার সময় ও পাস নম্বর:

  • মোট সময়: ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট (৭৫ মিনিট)
  • পাস নম্বর: লিখিত পরীক্ষায় ১০০ এর মধ্যে ন্যূনতম ৪০ পেতে হবে। ৪০ এর কম পেলে অকৃতকার্য বলে গণ্য হবেন এবং ভর্তির অযোগ্য বিবেচিত হবেন।

কারা আবেদন করতে পারবেন? (যোগ্যতা ও শর্তাবলী ২০২৫-২৬)

শুধু জিপিএ নয়, আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করলেই আপনি আবেদন করতে পারবেন। চলুন এক নজরে দেখে নিই:

  • নাগরিকত্ব: আবেদনকারীকে অবশ্যই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
  • শিক্ষাগত যোগ্যতা: বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
  • মোট জিপিএ: এসএসসি ও এইচএসসি মিলিয়ে ন্যূনতম জিপিএ ৮.৫০
  • একক জিপিএ (বেসরকারি): নীতিমালায় সরকারি মেডিকেলের জন্য এককভাবে জিপিএ’র কোনো নির্দিষ্ট শর্ত (যেমন ৪.০) উল্লেখ করা হয়নি, তবে বেসরকারি ক্ষেত্রে আলাদা শর্ত প্রযোজ্য হতে পারে।
  • জীববিজ্ঞান: এইচএসসিতে জীববিজ্ঞানে ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫০ থাকতে হবে।
  • এইচএসসি পাসের বছর: আবেদনকারীকে অবশ্যই ২০২৪ বা ২০২৫ সালে এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
  • এসএসসি পাসের বছর: আবেদনকারীকে ২০২২, ২০২৩ বা ২০২৪ সালের মধ্যে এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় পাস করতে হবে।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য যোগ্যতা

  • সরকারি মেডিকেল: এসএসসি ও এইচএসসি সমমানে মোট জিপিএ ৮.৫০ এবং জীববিজ্ঞানে ৩.৫০। তবে এককভাবে কোনোটিতে জিপিএ ৪.০ এর কম থাকা যাবে না।
  • বেসরকারি মেডিকেল: মোট জিপিএ ৭.০০ এবং জীববিজ্ঞানে ৩.৫০। তবে এককভাবে কোনোটিতে জিপিএ ৩.৫০ এর কম থাকা যাবে না।

মেধাতালিকা যেভাবে প্রস্তুত করা হবে (নম্বর বিভাজন)

ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকা মোট ২০০ নম্বরের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়। তবে এবারের নীতিমালায় জিপিএ থেকে নম্বর গণনার পদ্ধতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, সদ্য উত্তীর্ণদের জন্য: ১. ভর্তি পরীক্ষা: ১০০ নম্বর (লিখিত পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর) ২. জিপিএ নম্বর: ১০০ নম্বর

জিপিএ-এর ১০০ নম্বর যেভাবে গণনা করা হবে:

  • এসএসসি/সমমান পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ-এর ৮ গুণ
  • এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ-এর ১২ গুণ

উদাহরণ: যদি একজন শিক্ষার্থী এসএসসিতে জিপিএ ৫.০০ এবং এইচএসসিতে জিপিএ ৫.০০ পান, তার জিপিএ নম্বর হবে: (৫ x ৮) + (৫ x ১২) = ৪০ + ৬০ = ১০০

এই ১০০ নম্বরের সাথে ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর (ধরা যাক ৮৫) যোগ করে মোট নম্বর (১০০ + ৮৫ = ১৮৫) এর ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি করা হবে।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য: বিগত বছরগুলোতে এই গণনা ছিল (SSC GPA x ১৫) + (HSC GPA x ২৫) = ২০০ নম্বর। এবারের নীতিমালায় উল্লেখিত “৮ গুণ” এবং “১২ গুণ” পদ্ধতিটি একটি বড় পরিবর্তন, যা শিক্ষার্থীদের জিপিএ-এর ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমিয়ে লিখিত পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়াতে পারে।)

বিএমডিসির ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষের এই নতুন নীতিমালা নিঃসন্দেহে হাজারো ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর জন্য নতুন আশা সঞ্চার করেছে। জিপিএ কমানো এবং সেকেন্ড টাইমারদের নম্বর কাটার পরিমাণ হ্রাস করার সিদ্ধান্ত দুটিই অত্যন্ত সময়োপযোগী।

এর ফলে আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন এবং দ্বিতীয়বার চেষ্টাকারীরাও পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারবেন। মানবন্টনের পরিবর্তনটি শিক্ষার্থীদের পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি সাধারণ জ্ঞানের প্রতিও সমান মনোযোগী হতে উৎসাহিত করবে।

এখনই সময়, নতুন এই নীতিমালার আলোকে নিজের প্রস্তুতিকে শানিত করার। প্রতিটি দিন গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি নম্বর মূল্যবান। আপনার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের পথে এই পরিবর্তনগুলো সহায়ক হোক।

আরও পড়ুনএইচএসসি ফলাফল ২০২৫ প্রকাশ: পাসের হার ৫৮.৮৩%, জিপিএ-৫ পেলেন ৬৯,০৯৭ জন – রেজাল্ট দেখবেন যেভাবে

Leave A Reply

Your email address will not be published.