মাউশি’র ৬১০ পদের নিয়োগ: পাঁচ বছরের অনিশ্চয়তা ও প্রার্থীদের জীবনের গল্প
মাউশি নিয়োগের সর্বশেষ খবর: ৬১০ পদের ফল প্রকাশে কেন এত বিলম্ব?
বাংলাদেশের লাখো তরুণের কাছে সরকারি চাকরি মানে শুধু একটি পদ নয়, এটি একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ, সম্মান এবং পরিবারকে সহায়তা করার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন যখন বছরের পর বছর ধরে অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে থাকে, তখন তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)-এর চারটি পদের জন্য আবেদন করা হাজার হাজার প্রার্থী ঠিক এমন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।
যে স্বপ্নের শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে
২০২০ সালের ২২ অক্টোবর, যখন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস তার ভয়াল থাবা বিস্তার করছিল, ঠিক সেই সময়েই মাউশি ১০ থেকে ১৬তম গ্রেডের ৪ হাজার ৩২টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রদর্শক, গবেষণা সহকারী, সহকারী গ্রন্থাগারিক এবং ল্যাবরেটরি সহকারী—এই চারটি পদের জন্য লাখ লাখ প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালে, এবং ৩ হাজার ৪২২টি পদে নিয়োগও সম্পন্ন হয়। কিন্তু অজানা কারণে বাকি ৬১০টি পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে দাঁড়ায়।
লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং মূল্যায়নে নিয়োগবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি, এমন অভিযোগের কারণে ফলাফল প্রকাশ আটকে রাখা হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০২৪ সালের ৪ এপ্রিল লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় এবং একই বছরের ৬ জুন মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই মৌখিক পরীক্ষার ফল আজও প্রকাশ হয়নি।
অনিশ্চয়তার ক্যানভাসে আঁকা প্রার্থীদের জীবন
এই দীর্ঘসূত্রতা কেবল প্রশাসনিক জটিলতা নয়, এটি হাজার হাজার তরুণের জীবনের গল্প, তাদের হতাশা ও ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি। পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীরা তাঁদের মূল্যবান সময় হারিয়েছেন। অনেকেই এই চাকরির আশায় অন্য কোনো বিকল্প ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ ছেড়ে দিয়েছেন।
মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া জাকারিয়া হোসাইন তার হতাশার কথা প্রকাশ করে বলেন, “পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও আমাদের নিয়োগ অজানা কারণে আটকে আছে। ফলাফল প্রকাশ হলে অন্তত আমরা বুঝতে পারতাম আমাদের ভবিষ্যৎ কী।”
আরেকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রার্থী বলেন, “সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করেছি, কোচিং করেছি, এমনকি অন্য চাকরি ছেড়েও দিয়েছি। কিন্তু ফল প্রকাশ না হওয়ায় এখন আমরা দিশেহারা।” এই মানসিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা তাদের পরিবারকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
আন্দোলন থেকে হাইকোর্ট, তবু কেন নীরবতা?
অনির্দিষ্টকালের এই অপেক্ষার অবসান ঘটাতে প্রার্থীরা একসময় বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামেন। চলতি বছরের ১৭, ১৮ ও ১৯ জুন মাউশি ভবনের সামনে তাঁদের অবস্থান কর্মসূচি ও অনশন গণমাধ্যমের নজরে আসে। এরপর প্রার্থীরা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
আদালতের রুল জারির পর কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও, বাস্তব পরিস্থিতি এখনো একই। ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ দ্রুত ফল প্রকাশের জন্য রুল জারি করেন, যা প্রার্থীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। কিন্তু এরপরও কেন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রশাসনিক জটিলতা নাকি অন্য কিছু?
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাউশির কিছু কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছেন যে, প্রশাসনিক জটিলতা এবং অভিযোগ যাচাইয়ের কারণেই এই বিলম্ব। তবে এই বিলম্বের মূল কারণ সম্পর্কে তাঁরা স্পষ্ট করে কিছু বলতে রাজি হননি। মাউশির উপপরিচালক ও নিয়োগ কমিটির সদস্য মো. শাহজাহান এবং তথ্য কর্মকর্তা কামরুন নাহার—কেউই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে ইচ্ছুক নন। এই নীরবতা পুরো প্রক্রিয়াকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
শিক্ষাবিষয়ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই দীর্ঘসূত্রতা শুধু প্রার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও শূন্য পড়ে আছে, যা প্রশাসনিক কাজে অদক্ষতা তৈরি করছে।
অনিশ্চয়তার শেষ কোথায়?
পাঁচ বছরের এই অনিশ্চয়তা প্রার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। একজন মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে অনেকেই হতাশায় ভুগছেন, যা ভবিষ্যতে সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও ফল প্রকাশ না হওয়ায় প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়ছে। তাঁরা বলছেন, প্রয়োজন হলে আবারও তাঁরা আন্দোলনে নামবেন।
যদি দ্রুত এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা না যায়, তাহলে সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের আস্থা নষ্ট হবে। দেশের মেধাবী তরুণরা দীর্ঘসূত্রতার কারণে হতাশ হয়ে পড়বে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আরও পড়ুন: সরকারি ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ: বিনামূল্যে কোর্স, প্রতিদিন ২০০ টাকা ভাতা এবং আবেদন প্রক্রিয়া
[…] আরও পড়ুন: মাউশি’র ৬১০ পদের নিয়োগ: পাঁচ বছরের অন… […]