ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: সাত কলেজের ভবিষ্যৎ বনাম উচ্চশিক্ষার সংকোচন – বিতর্কের গভীরে এক অনুসন্ধান
Dhaka Central University: The Core Debate Over Seven Colleges' New Structure and Future
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়টি হলো ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (DCU) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর ভার বহন করা সাত কলেজকে নিয়ে এই নতুন কাঠামোর পরিকল্পনা যখন সামনে আসে, তখন একদিকে যেমন আশার সঞ্চার হয়, তেমনি অন্যদিকে জন্ম নেয় গভীর উদ্বেগ ও আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধিভুক্তি পরিবর্তনের দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়ার পর সাত কলেজের এই নতুন রূপান্তর কি সত্যিই উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের পথ প্রশস্ত করবে, নাকি এটি কেবলই পুরোনো সংকটকে নতুন মোড়কে হাজির করবে?
প্রথম থেকেই ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষক ক্যাডারদের পদ বিলুপ্তির ঝুঁকি, ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোর স্বতন্ত্র কাঠামো হারানোর ভয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, উচ্চমাধ্যমিক (HSC) স্তরের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা। এই নিবন্ধে আমরা DCU-এর প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের গভীরে যাব, এর কাঠামো বিশ্লেষণ করব এবং এই বহুমুখী সংকটের একটি যৌক্তিক ও মধ্যস্থতাকারী সমাধান খোঁজার চেষ্টা করব।
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (DCU) অধ্যাদেশ: কী আছে নতুন কাঠামোতে?
প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (Dhaka Central University) গঠনের উদ্দেশ্য হলো সাত কলেজকে একটি একক ও স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় এনে শিক্ষার মান, পরীক্ষা পরিচালনা এবং সেশন জট নিরসন করা। নতুন অধ্যাদেশে বেশ কিছু আমূল পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কলেজগুলোর পরিচালন পদ্ধতিকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিতে পারে।
হাইব্রিড পদ্ধতিতে ক্লাস ও পরীক্ষার নিয়ম (DCU হাইব্রিড শিক্ষা পদ্ধতি)
DCU-এর অন্যতম প্রধান প্রস্তাবনা হলো হাইব্রিড শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা। এই পদ্ধতিতে, শিক্ষার্থীরা আংশিকভাবে ক্যাম্পাসে এবং আংশিকভাবে অনলাইনে ক্লাস করবে। এই মডেলটি মূলত আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো অনুসরণ করে তৈরি, কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে সাত কলেজের মতো বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী এবং সীমিত প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে এই পদ্ধতি কতটা সফল হবে?
ক্যাম্পাসে ডিসিপ্লিনভিত্তিক বিভাজন: কোন কলেজে কী পড়ানো হবে?
নতুন কাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো সাত কলেজকে তাদের ঐতিহ্যবাহী বহুমাত্রিক শিক্ষা থেকে বের করে এনে ডিসিপ্লিনভিত্তিক স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এর অর্থ হলো, প্রতিটি কলেজ কেবল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে (যেমন বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য) শিক্ষাদান করবে। এটি কলেজগুলোর ঐতিহ্যগত পরিচয়ের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
DCU-এর অধীনে সাত কলেজের প্রস্তাবিত বিভাগসমূহ (স্কুলভিত্তিক):
- স্কুল অব সায়েন্স (School of Science): (উদাহরণস্বরূপ) ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজে গণিত, ফলিত গণিত, প্রাণিবিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি কেন্দ্রীভূত হবে।
- স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ (School of Arts & Humanities): (উদাহরণস্বরূপ) কবি নজরুল ও তিতুমীর কলেজে বাংলা, ইতিহাস, দর্শন, ইংরেজি ইত্যাদি কেন্দ্রীভূত হবে।
- স্কুল অব কমার্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (School of Commerce & Management): (উদাহরণস্বরূপ) বাঙলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা কলেজে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স ইত্যাদি কেন্দ্রীভূত হবে।
- স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সেস (School of Social Sciences): (উদাহরণস্বরূপ) সাত কলেজের মধ্যে একটিতে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি কেন্দ্রীভূত করা হবে।
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: বেলা ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কেন ক্লাস?
অধ্যাদেশে ক্লাসের সময় নিয়েও বিতর্কিত প্রস্তাব রয়েছে। প্রাথমিকভাবে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ক্লাসগুলো দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মূল কারণ, কলেজ ক্যাম্পাসগুলোর ভবন বা অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে DCU-এর অধীনে এলেও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ক্লাসগুলো সকালে চলার কারণে সংস্থানগত সংকট এড়ানো। তবে, এই অদ্ভুত সময়সূচি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও নিরাপত্তার বিষয়ে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ: ‘নতুন বিশ্ববিদ্যালয় মানেই উচ্চশিক্ষার সংকোচন’?
DCU প্রতিষ্ঠা নিয়ে যে আন্দোলন ও বিতর্ক চলছে, তার প্রধান কারণ হলো অংশীজনদের মধ্যে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ও গভীর উদ্বেগ। এই উদ্বেগগুলি কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যৎ ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত স্থিতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের পদ বিলুপ্তির ঝুঁকি কেন দেখছেন শিক্ষকেরা?
সাত কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য এবং তারা সরকারি কর্মচারী। ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি যদি পুরোপুরি স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে এই শিক্ষকেরা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে গণ্য হবেন। এর ফলে, তাদের বর্তমান ক্যাডার পদ, পদোন্নতির সুযোগ এবং চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।
অধিভুক্তি পরিবর্তনের ক্ষণিকের ফল
অধিভুক্তি পরিবর্তনের ক্ষণিকের ফল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তিতে সাত কলেজের ফলাফল বিপর্যয় এবং সেশন জট—যা প্রমাণ করে প্রস্তুতি ছাড়া পরিবর্তন কত ভয়াবহ হতে পারে। ২০১৪ সালে যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি স্থানান্তরিত হয়, তখন অনিয়মিত পরীক্ষা ও ফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রিতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করেছিল। এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্টতা ছাড়া যেকোনো বড় পরিবর্তন হিতে বিপরীত হতে পারে।
এই অনিশ্চয়তা দূর করতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার শিক্ষকেরা তাদের স্বতন্ত্র পদ ও মর্যাদা বজায় রাখার দাবি জানাচ্ছেন।
উচ্চমাধ্যমিক (HSC) স্তর বিলুপ্তির আশঙ্কা: ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
সাত কলেজের ঐতিহ্য শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বিশেষ করে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক (HSC) স্তরের হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। DCU প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যদি কলেজগুলো শুধু উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তবে উচ্চমাধ্যমিক স্তর বিলুপ্ত হবে—এই আশঙ্কা থেকেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামেন।
ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র কাঠামো হারানোর ভয়: ইডেন-ঢাকা কলেজের বিশেষ উদ্বেগ
ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ—প্রতিটি কলেজেরই নিজস্ব একটি ঐতিহ্য ও বিশেষত্ব রয়েছে। ডিসিপ্লিনভিত্তিক স্কুল গঠনের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বতন্ত্র নাম, পরিচিতি ও শিক্ষা কাঠামো হারানোর ভয় তৈরি হয়েছে। ছাত্র সংগঠন ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজের ঐতিহ্য ধরে রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন।
DCU কাঠামো নিয়ে মূল আপত্তি কোথায়? (তুলনামূলক বিশ্লেষণ)
DCU-এর ধারণাটি উচ্চশিক্ষার আধুনিকায়নের ইঙ্গিত দিলেও, এর বাস্তবায়ন এবং প্রস্তাবিত কাঠামোর দুর্বলতা নিয়েই প্রধান আপত্তি।